মাঠের এক পাশের সীমানা ৩৫ গজের কম। ম্যাচের আগের দিন থেকে এ নিয়ে বিরক্ত বাংলাদেশ দল। টস করতে যাওয়ার আগেও মাশরাফি বিন মুর্তজার মুখে সেই বিরক্তি ছাপ, “এভাবে প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলে লাভ কী!” ম্যাচের পর সেই বিরক্তি আর থাকার কথা নয়। জেতা ম্যাচ হারার হতাশায় আড়াল আর সব কিছুই!
এমনিতে প্রস্তুতি ম্যাচে জয়-পরাজয় বড় কিছু নয়। তবে যেভাবে হারল দল, হতাশার সেটিই। চাইলেও হারা কঠিন, এমন ম্যাচও হেরে বসল বাংলাদেশ। নয় আর দশে নামা দুই ব্যাটসম্যানের অবিশ্বাস্য জুটি জয় এনে দিল পাকিস্তানকে।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রস্তুতি ম্যাচে পাকিস্তানের কাছে দুই উইকেটে হেরেছে বাংলাদেশ। ৩৪১ রানের পুঁজি নিয়ে বাংলাদেশ ম্যাচ হেরেছে ৩ বল আগে।
এক পাশের ছোট সীমানায় ৩৪১ রান নিরাপদ ছিল না অবশ্যই। তবে দারুণ বোলিংয়ে বাংলাদেশ ছিল সহজ জয়ের পথে। শেষ ৬ ওভারে পাকিস্তানের প্রয়োজন ছিল ৮২ রান, হাতে উইকেট দুটি। কে ভাবতে পেরেছিল, এই ম্যাচ হারবে বাংলাদেশ!
কিন্তু শেষের বাজে বোলিং, তার চেয়েও বাজে ফিল্ডিং আর ক্যাচ মিসের মহড়ায় হারই হলো সঙ্গী। শেষ ওভারেও মাশরাফির বলে ফাহিম আশরাফের ক্যাচ ছাড়লেন মেহেদী হাসান মিরাজ। জাতীয় দলের হয়ে প্রথমবার খেলতে নামা ফাহিমই পাকিস্তানের জয়ের নায়ক।
ম্যাচের মোড় বদল ৪৫তম ওভারে। ফাহিমের ঝড়ে ওই ওভার থেকে এল ১৯ রান। এরপর ফাহিম চালিয়েই গেলেন, দারুণ সঙ্গ দিলেন হাসান আলি।
সাকিবের ওভার থেকে এলো ১৩, মাশরাফির ওভার থেকে ১৬। শফিউল দিলেন ১০ রান, তাসকিন ১১।
শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ১৩। প্রথম বলেই মাশরাফির লেংথ বলে ফাহিমের ছক্কা। পরের বলটিতেই ছিল সুযোগ। স্লোয়ারে ফাহিম ক্যাচ দিয়েছিলেন মিডউইকেটে। কিন্তু মিরাজ পারলেন না হাতে জমাতে। ওই ক্যাচ নিতে পারলেও হয়ত জিততো বাংলাদেশ। উল্টো এলো ৩ রান।
পরের বলে হাসানের ব্যাটের কানায় লেগে কিপারের ওপর দিয়ে বাউন্ডারি। স্তব্ধ বাংলাদেশ দল।
৩০ বলে ৬৪ রানে অপরাজিত ফাহিম, যিনি মূলত বোলিং অলরাউন্ডার। ১৫ বলে অপরাজিত ২৭ হাসান। নবম উইকেটে ৪১ বলে দুজনের জুটি ৯৩ রানের!
এভাবে হারাই শুধু নয়, ম্যাচে বাংলাদেশ অস্বস্তির কাঁটায় বিদ্ধ তিন বিভাগেই। ফিল্ডিং ম্যাচ জুড়েই ছিল বাজে। ব্যাটিংয়েও ছিল খামতি; বোলিংয়ের শেষ ভাগ ছিল না গোছানো।
দারুণ সেঞ্চুরি করেছেন তামিম ইকবাল। ইমরুল কায়েসের সঙ্গে গড়েছেন দুর্দান্ত জুটি। কিন্তু বাকি বেশকজন দারুণ শুরু করেও খেলতে পারেননি বড় ইনিংস। নইলে এই ম্যাচে চারশ রানের পথে ছিল বাংলাদেশ।
আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে দুটি অর্ধশতক ও একটি ৪৭ রানের ইনিংস আছে তামিমের। সেঞ্চুরি না পাওয়ায় আক্ষেপ নিশ্চয়ই আছে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রস্তুতি ম্যাচে ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন মূল টুর্নমেন্টেও ভালো কিছু করার।
এক পাশ বেশি ছোট বলে যে সুর ছিল হাওয়ায়, শুরুতে রানের স্রোত প্রবাহিত হয়নি সেই একই তালে। তামিম ও সৌম্য ছিলেন বেশ সতর্ক। প্রথম ৮ ওভারে রান ছিল ৩২।
সৌম্য ফিরে গেছেন এর মধ্যেই। জুনাইদের বাড়তি লাফানো বলে ক্যাচ দিয়েছেন স্লিপে।
নবম ওভার থেকে হঠাৎ জোয়ার। জুনাইদের ওই ওভারে তামিমের এক ছক্কা, তিন চারে রান আসে মোট ২৫।
প্রথমটির মতো তামিমের পরের দুটি ছক্কাও ছিল লং অফ দিয়ে, ওয়াহাব রিয়াজ ও ইমাদ ওয়াসিমকে। পরের লেগ স্পিনার শাদাবকে ছক্কা মারেন স্লগ করে মিড উইকেট দিয়ে।
৩৯ বলে পঞ্চাশ স্পর্শ করেছিলেন তামিম। শুরুতে খানিকটা সময় নিলেও পরে চালিয়ে খেলে ইমরুলের পঞ্চাশ ৪৭ বলে।
লেগ স্পিনার শাদাবকে সুইপ করতে গিয়ে ইমরুল এলবিডব্লিউ ৬১ রানে। দ্বিতীয় উইকেটে ১৪২ রানের জুটি এসেছে ১২২ বলে।
রানের গতি একই ছিল পরের জুটিতেও। উইকেট গিয়েই হাসান আলিকে ছক্কা মারেন মুশফিক। তামিম সেঞ্চুরি ছুঁয়েছেন ৮৮ বলে।
তখন মাত্র ৩২ ওভার। হাতছানি ছিল আরও বড় কিছুর। কিন্তু তামিম থামলেন সেঞ্চুরি পেরিয়েই। শাদাবকে ছোট সীমানা দিয়ে স্লগ করতে গেলেন, ব্যাটের কানায় লেগে বল শর্ট থার্ডম্যানে। ৯৩ বলে ১০২ রানের ইনিংসে ৯টি চার, ৪টি ছক্কা।
পরের ওভারেই ইমাদ ওয়াসিমকে পরপর দু বলে মিড উইকেটের দুপাশ দিয়ে ছক্কা মেরেছেন মুশফিক। তবে রানের সেই গতি পরে আর থাকেনি, বড় ইনিংসও আসেনি কারও কাছ থেকে।
৩৭ বলে ৪৬ রান করে মুশফিক আউট হয়েছেন উড়িয়ে মারতে গিয়ে। থিতু হয়েও এক ওভারে ফিরেছেন মাহমুদউল্লাহ-সাকিব। শেষ দিকে মিরাজ-মাশরাফি পারেননি ঝড় তুলতে। কেবল মোসাদ্দেক করেছেন ১৫ বলে ২৬।
রান তাড়ায় পাকিস্তান ২ উইকেট হারিয়েছিল দ্রুতই। তাসকিন তুলে নেন আজহার আলিকে, বাবর আজমকে মাশরাফি।
গত কদিনের ধারা মেনে এদিনও অধিনায়কের বলে ক্যাচ পড়েছে। শেষে মিরাজের ওই মিসের আগেও ইমাদ ওয়াসিমকে জীবন দিয়েছেন তাসকিন।
মাঝে মোহাম্মদ হাফিজ ও শোয়েব মালিক টেনেছেন পাকিস্তানকে। ৬৬ বলে ৭২ করা মালিকের বিদায়েই ম্যাচ কার্যত শেষ মনে হচ্ছিলে। কে জানত, এত নাটক জমা আছে শেষে!
বাংলাদেশ অবশ্য এদিন বিশ্রাম দিয়েছিল মুস্তাফিজুর রহমান ও রুবেল হোসেনকে। তাদের ছাড়া জয়টা হতে পারত আত্মবিশ্বাসের বড় টনিক। উল্টো এখন অস্বস্তির আনাগোনা। ব্যাটিং-বোলিং যেমন-তেমন, ফিল্ডিং যে বাজে হচ্ছে প্রায় নিয়মিতই!
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ৩৪১/৯ (তামিম ১০২, সৌম্য ১৯, ইমরুল ৬১, মুশফিক ৪৬, সাকিব ২৩, মাহমুদউল্লাহ ২৯, মোসাদ্দেক ২৬, মিরাজ ১৩*, মাশরাফি ১, সানজামুল ০*; জুনাইদ ৪/৭৩, হাসান ২/৫৮ ফাহিম ০/৩৫, ওয়াহাব ০/৬৮, হাফিজ ০/১১, শাদাব ২/৫৫, ইমাদ ০/৩৮)।
পাকিস্তান: ৪৯.৩ ওভারে ৩৪২/৮ (আজহার ৪, শেহজাদ ৪৪, বাবর ১, হাফিজ ৪৯, মালিক ৭২, সরফরাজ ৫, ইমাদ ৪৫, শাদাব ৭, ফাহিম ৬৪*, হাসান ২৭*; মাশরাফি ১/৬৮, তাসকিন ১/৮০, শফিউল ১/৪৬, সৌম্য ০/২৫, সাকিব ১/৪১, সানজামুল ০/১৭, মোসাদ্দেক ১/২৯, মিরাজ ২/৩০)।
ফল: পাকিস্তান ২ উইকেটে জয়ী